- Info
- Storyline
- Languages
কাবিল ও হাবিল নামে দুই ভাইয়ের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের ইতিহাস অনুসারে কাবিল ও হাবিলের মাধ্যমেই প্রথম কুরবানি শুরু হয়।[1] তাদের মধ্য থেকেই পৃথিবীতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এবং তাদের মাধ্যমেই মৃতদেহ কবর দেবার নিয়ম চালু হয়।[2] জুমার নামাজের আগে কিংবা কুরবানির ঈদের নামাজের আগে বিশেষ আলোচনায় কুরবানির ইতিহাস সম্বন্ধে আলোকপাত করতে গিয়ে ইমাম সাহেবরা প্রায় সময়ই কাবিল ও হাবিলের ঘটনার উল্লেখ করেন। খ্রিস্টধর্মে তাদেরকে কেইন ও এবেল নামে ডাকা হয়।[3] কাবিল ও হাবিলের ঘটনা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে উল্লেখ করতে হবে তাদের পিতা হযরত আদম (আ:) ও মাতা বিবি হাওয়া (আ:) এর কথা। হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়া (আ:) উভয়ে জান্নাতের সুসজ্জিত বাগানে বসবাস করছিলেন। কিন্তু তাদের পিছু লাগলো ‘ইবলিস’ নামে এক পাপিষ্ঠ শয়তান। ইবলিস চাইলো তারা যেন সুখের জান্নাতে থাকতে না পারে। যতটা না সুখের জান্নাত থেকে বিতাড়িত করার ইচ্ছে ছিল ইবলিসের, তারচেয়েও বেশি ইচ্ছে ছিল তারা যেন আল্লাহর দেয়া আদেশ অমান্য করে তাঁকে নাখোশ করে। আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:)-কে আল্লাহ একটি বিশেষ গাছের ফল খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করেছিলেন। ইবলিস বেছে বেছে ঐ বিশেষ ফলটিকেই টার্গেট করলো। দুজনকে প্ররোচিত করে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঐ গাছের ফল খাইয়ে দিলো। আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:) দৃশ্যত পাপ করে বসলেন। জান্নাতে পাপের স্থান নেই, তাই শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। বলা হলো, পৃথিবীতে ভালো কাজ করে নিজেদের মার্জনা করতে পারলে তারা আবারো জান্নাতে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু অশান্তি তারপরও রয়ে গেল, কারণ পৃথিবীতেও অস্তিত্ব বিরাজমান সেই পাপিষ্ঠ শয়তান ইবলিসের। ইবলিস শয়তান তার শেষ চাওয়া হিসেবে আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ কয়েকটি ক্ষমতা চেয়ে নিয়েছিল। অভিশপ্ত হবার আগে ইবলিস আল্লাহর অনেক ইবাদত করেছিল। এই ইবাদতের প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ তাকে তার চাহিদা অনুসারে এই ক্ষমতাগুলো প্রদান করেছিলেন। প্রাপ্ত ক্ষমতাগুলোর মধ্যে একটি হলো, যেকোনো সময় বিশ্বের যেকোনো স্থানে সে অবস্থান করতে পারবে।[4] সে হিসেবে আদম-হাওয়ার পৃথিবীতে চলে আসা তার জন্য তেমন কঠিন কিছু নয়। যা-ই হোক, পৃথিবীতে আগমনের পর হযরত আদম (আ:) ও বিবি হাওয়া (আ:) এর সন্তান জন্ম হতে লাগলো। ধীরে ধীরে মানুষ বাড়তে লাগলো পৃথিবীতে। কিন্তু এখানে দৃশ্যত একটি সীমাবদ্ধতা থেকে গেল। আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:) যেহেতু পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী, তাই তাদের পরের প্রজন্মে যত সন্তানের জন্ম হবে তারা সকলেই হবে ভাই-বোন। ইসলামী নিয়ম অনুসারে, ভাই বোনের মাঝে কখনো বিয়ে হয় না। সে হিসেবে এটিই হতো পৃথিবীর শেষ মানব প্রজন্ম। এরপর মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতো। কিন্তু এখানে তো পুরো মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন, তাই বিশেষ একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে এর সমাধান করা হলো। বিবি হাওয়ার গর্ভে তখন সন্তান জন্ম নিতো জোড়ায় জোড়ায়। প্রতি জোড়ায় একজন ছেলে আর একজন মেয়ে জন্ম হতো। একই জোড়ার ছেলে ও মেয়েরা পরস্পর বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ে করতে হলে ভিন্ন জোড়ার কাউকে করতে হবে। কাবিল ও হাবিল ছিল ভিন্ন জোড়ার, তাই তাদের ব্যাপারটি স্বাভাবিক নিয়মেই সমাধান হয়ে যায়। একজন আরেকজনের জোড়ার মেয়েকে বিয়ে করবে। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা দেখা দেয়। হাবিলের জোড়ার মেয়েটি তেমন সুন্দরী ছিল না। সেই তুলনায় কাবিলের জোড়ার মেয়েটি ছিল অনেক বেশি সুন্দরী। নিয়ম অনুসারে হাবিল অধিক সুন্দরী মেয়েটিকে পায় আর কাবিল পায় কম সুন্দরী মেয়েটিকে। কিন্তু কাবিল বেঁকে বসে, সে হাবিলের জোড়ার মেয়েটিকে বিয়ে করবে না। যেভাবেই হোক, নিজের জোড়ার সুন্দরী মেয়েটিকেই বিয়ে করবে। এমতাবস্থায় পিতা হযরত আদম (আ:) একটি মীমাংসা করলেন। তাদের দুজনকে আল্লাহর নামে কুরবানি দিতে বললেন। যার কুরবানি আল্লাহ গ্রহণ করবেন, তার ইচ্ছাই জয়ী হবে। কার কুরবানি গৃহীত হলো আর কার কুরবানি গৃহীত হলো না, তা কীভাবে বোঝা যায়? তখনকার কুরবানি এখনকার কুরবানির মতো ছিল না। সে সময়ে কোনো জিনিস কুরবানি দিলে আসমান থেকে আগুন এসে ঐ জিনিসকে পুড়িয়ে দিতো। কুরবানির বস্তুকে ভূমি থেকে উপরে কোনো স্থানে উপস্থাপন করা হতো, আকাশ থেকে আগুন এসে যদি বস্তুকে পুড়িয়ে দিতো, তাহলে বোঝা যেতো আল্লাহ কর্তৃক কুরবানী গৃহীত হয়েছে। পিতা আদম (আ:) এর দেওয়া মীমাংসা অনুসারে তারা উভয়েই কুরবানির বস্তু উপস্থাপন করলো আল্লাহর কাছে। হাবিল একটি সুস্থ ও মোটাতাজা দুম্বা উৎসর্গ করলো আর কাবিল তার কিছু সবজি ও শস্য উৎসর্গ করলো। তখন সবজি ও শস্যও কুরবানির জন্য উৎসর্গ করা যেতো। কোনো কোনো উৎস থেকে জানা যায়, হাবিল উৎসর্গ করেছিল উৎকৃষ্ট মানের দুম্বা আর কাবিলের শস্য ছিল নিকৃষ্ট মানের।[5], [6] আল্লাহ হাবিলের কুরবানিকেই কবুল করলেন। উপর থেকে আগুন দিয়ে দুম্বাটিকে পুড়িয়ে নিলেন, কিন্তু কাবিলের শস্যকে কিছুই করলেন না। সে হিসেবে বিয়ের নিয়ম আগের মতোই রইলো, হাবিল বিয়ে করবে কাবিলের জোড়ায় জন্ম নেয়া মেয়েটিকে। কিন্তু কাবিল এই অপমান সহ্য করতে পারলো না। সে ভাবলো, হাবিলের জন্য তার কুরবানি আল্লাহ গ্রহণ করেননি। কুরবানিতে প্রত্যাখ্যাত হওয়াতে এবং স্ত্রী হিসেবে কাঙ্ক্ষিত মেয়েকে না পাওয়াতে সে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে গেল। ক্রোধের বশে হাবিলকে সে বললো, তোর ইচ্ছা কোনোভাবেই আমি পূরণ হতে দেবো না। প্রয়োজনে তোকে হত্যা করবো, যেন তুই আমার জোড়ার মেয়েটিকে বিয়ে করতে না পারিস।[7] কোনো কোনো উৎস থেকে জানা যায়, তাকে এমন সর্বনাশা ভাবনার উস্কানি দিয়েছিল সেই পাপিষ্ঠ ইবলিস শয়তান।[8] কাবিলের এমন আচরণে হাবিল অনেক সুন্দর উত্তর দিয়েছিল। সে বলেছিল, আল্লাহ তাদের কুরবানিই কবুল করেন যার উদ্দেশ্য সৎ।[9] আর তুমি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আমার গায়ে আঘাত করলেও, আমি তোমাকে কিছু করবো না। কারণ আমি আমার প্রতিপালককে ভয় করি।[10] কিন্তু এই কথায় কাবিলের উদ্দেশ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সে হত্যা করলো তার আপন ভাইকে।[11] এরপরই কাবিলের মন গলে যায় এবং অনুভব করে, আহারে, কত বড় ভুল করে ফেললো সে! নিজের ভাইকে নিজ হাতে মেরে ফেললো, এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা আর কী হতে পারে! ভেতরে ভেতরে সে অনেক অনুতপ্ত হলো এবং নিজের অপকর্ম কীভাবে ঢাকবে, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো। তখনো মৃতদেহ সৎকারের ব্যাপারে কোনো নিয়ম তৈরি হয়নি, কারণ এর আগে কোনো মানুষের মৃত্যু ঘটেনি। মৃত দেহটিকে নিয়ে কী করবে এ নিয়ে যখন সে চিন্তায় মগ্ন তখন দেখলো, একটি কাক তার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে একটি গর্ত করলো। তারপর সেই গর্তে একটি মৃত কাককে টেনে এনে কবর দিয়ে দিলো।[12] এটি দেখে কাবিল ভাবলো, তাকেও হয়তো এভাবে কবর দিতে বলা হচ্ছে। তাই একটি গর্ত করে সে তার ভাইকে কবর দিয়ে দিলো। ইসলামের ইতিহাস অনুসারে এটিই ছিল মানবজাতির প্রথম কবর। কোনো কোনো উৎস থেকে জানা যায়, কাক দুটি ছিল ফেরেশতা এবং এদেরকে আল্লাহই পাঠিয়েছিলেন, যেন এদের দেখে কাবিল শিখতে পারে।